بسم الله الرحمن الرحيم
ফুলছোঁয়া। চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ থানাধীন বাকিলা বাজারের অদূরে অবস্থিত একটি রত্নগর্ভা গ্রাম। কোনো কালে এখানে ফুটবে একটি সুবাসিত ফুল এবং সে ফুলের খুশবুতে মাতোয়ারা হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে আসবে অসংখ্য মৌমাছি- হয়ত এমনটি ভেবেই কেউ গ্রামটির নাম দিয়েছিল ‘ফুলছোঁয়া’। সত্যি, আল্লাহ তা’আলা সেই নিভৃত পল্লীতে ফুটিয়েছেন একটি হৃদয়কাড়া সুবাসভরা ফুল। যার পবিত্র ‘ছোঁয়া’ গ্রহণ করতে ছুটে আসছে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলার ফুলপ্রেমীরা। প্রতি বছরই যেন ফুলটি বড় হচ্ছে আর বিমুগ্ধ দর্শনার্থী ও ছোঁয়াপ্রার্থীদের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি কোনো গাছের ফুল নয়; বরং এ হল ঐশী সুষমায় উদ্ভাসিত, সুন্নতে নববীর পবিত্র সুরভি নিয়ে প্রস্ফুটিত আলোকিত আত্মার অধিকারী ফুলের মতো একটি সুরভিত মানুষ। সে প্রিয় মানুষটি হলেন রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ইলমী মারকায ফরিদাবাদ মাদরাসার দীর্ঘ দিনের নন্দিত মুহাদ্দিস ও প্রধান মুফতী পীরে কামেল শাইখুল হাদীস আল্লামা আবু সাঈদ দামাত বরাকাতুহুম।
১৯৬২ ঈসায়ী সালের ১৮ রমযান বুধবার সুবহে সাদেকের সময় ফুলছোঁয়ার সম্ভ্রান্ত মুসলিম দীনদার পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতার নাম মৌলভী জনাব আবদুল লতীফ, পিতামহের নাম জনাব জমীরুদ্দীন মোল্লা, প্রপিতামহের নাম জনাব হানীফ মোল্লা ইবনে ফানা মিঞা। তাঁর পিতা মৌলভী জনাব আবদুল লতীফ সাহেব স্থানীয় স্কুল ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। খুবই দীনদার ও অন্তরালোকসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তাই তো উজানীর কারী ইবরাহীম সাহেব রহ. তাকে নিজের নাতনির জামাতা হিসেবে চয়ন করেছেন। এ হিসেবে মুফতী আবু সাঈদ সাহেব বংশগতভাবেই পীর আউলিয়ার বংশধর। ধমনীতে তাঁর বরেণ্য পীর মাশায়েখের শোণিতধারা প্রবহমান। কারী ইবরাহীম সাহেব রহ.-এর তৃতীয় সাহেবজাদা কারী শামসুল হক সাহেব রহ. তাঁর শ্রদ্ধেয় নানা। কারী ইবরাহীম সাহেব রহ. তাঁর এগার ছেলের মধ্যে একমাত্র শামসুল হক সাহেবকেই খেলাফত দিয়ে যান। হযরত মাওলানা মোবারক করীম সাহেব (রহ.) এক দিকে তাঁর আপন মামা অপর দিকে শ্রদ্ধেয় শ্বশুর।
গ্রামের সাবাহী মক্তব ও প্রাইমারী স্কুলে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়নের পর মুফতী সাহেব চলে যান নানার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী উজানী মাদারাসায়। সেখানে শুরু থেকে কাফিয়া জামাত পর্যন্ত সুনামের সাথে পড়ালেখা করেন। তারপর রাজধানীর সর্ববৃহৎ দীনি ইদারা ফরিদাবাদ মাদরাসায় ভর্তি হন। এখানে শরহে জামী জামাত থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৪০৪-০৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৮৪-৮৫ ঈ. ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। সেখানে পুনরায় দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন এবং মুফতী হাবীবুর রহমান খায়রাবাদী সাহেবের কাছে ইফতার তামরীন করেন। দাওরায়ে হাদীসের বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ৫০০ নম্বরের পরীক্ষায় তিনি মোট ৪৮৫ নম্বর পান। উল্লেখ্য, দারুল উলূমে প্রতি বিষয়ে ৫০ নম্বরে পরীক্ষা হয়। সে হিসেবে প্রতি কিতাবে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল নিম্নরূপ
কিতাব | পূর্ণমান | প্রাপ্ত নম্বর |
বুখারী | ৫০ | ৫০ |
তিরমিযী | ৫০ | ৫০ |
মুসলিম | ৫০ | ৪৯ |
শামায়েল | ৫০ | ৫০ |
ইবনে মাজাহ | ৫০ | ৪৮ |
তাহাভী | ৫০ | ৪৮ |
আবু দাউদ | ৫০ | ৪৬ |
নাসাঈ | ৫০ | ৪৯ |
মুয়াত্তা মালেক | ৫০ | ৪৯ |
মুয়াত্তা মুহাম্মাদ | ৫০ | ৪৬ |
বুখারী শরীফ ও তিরমিযী শরীফ উভয় কিতাব দারুল উলূম দেওবন্দের নন্দিত মুহাদ্দিস মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী দা.বা.-এর কাছে পড়ার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেন। শাইখুল হাদীস মাওলানা নাসির খান সাহেব অসুস্থ থাকায় সে বছর বুখারী শরীফের দরস হযরত পালনপুরীকেই দিতে হয়েছে।
দারুল উলূম দেওবন্দ থাকাবস্থায়ই ফরিদাবাদ মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। প্রথম বছর থেকেই ইফতা বিভাগের প্রধান মুফতীর পদ অলংকৃত করেন। নিরন্তর অধ্যাবসায় ও গভীর নিমগ্নতার সাথে ফিকহ শাস্ত্রের কিতাবাদি অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে এ বিষয়ে বিস্ময়কর পান্ডিত্য অর্জন করেন এবং ফাতাওয়া ও মাসাইলের জগতে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রূপে আবির্ভূত হন। তিনি দেশী-বিদেশী অসংখ্য বুযুর্গ ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের পুণ্যময় সাহচর্যে ধন্য হয়েছেন। হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত শাহ্ আশরাফ আলী (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলিফা ভারতের জালালাবাদ মাদরাসার শায়েখ মাওলানা মসিহুল্লাহ খান রহ., শাইখুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া রহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা সাহারানপুর মাদরাসার শাইখুল হাদীস আল্লামা ইউনুস সাহেব ও চট্টগ্রামের সুপ্রসিদ্ধ বুযুর্গ, রূহানী জগতের প্রাণপুরুষ আল্লামা সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.) প্রমুখ মাশায়েখে এজামের দীর্ঘ সুহবত ও সান্নিধ্য লাভের মাধ্যমে নিজের অন্তরাত্মাকে কলুষমুক্ত ও আলোকিত করেন। কাক্সিক্ষত পথ অতিক্রম করে আল্লামা সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.)-এর কাছ থেকে ইজাযত ও খেলাফত প্রাপ্ত হন এবং পরবর্তীতে ইলম ও আধ্যাত্মিকতার সুসমন্বিত এক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
হযরত মাওলানা সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.) তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে মুফতী সাহেবের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা দীনের অনেক কাজ নিবেন, তাই তিনি মুফতী সাহেবকে নিজ এলাকায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রিয় শায়খের নির্দেশ পেয়ে মুফতী সাহেব তাঁর পিতার দেয়া ত্রিশ শতাংশ জায়গায় ২০ শাওয়াল ১৪১৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৯৫ সনের ২২ মার্চ বুধবার একটি কওমী মাদরাসার ভিত্তি স্থাপন করেন। উজানীর পীর হযরত মাওলানা মুবারক করীম সাহেব (রহ.) ও ফরিদাবাদ মাদরাসার সাবেক শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হাফীয (রহ.)সহ দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখে এজামের বরকতময় হাতে এক অনাড়ম্বর রূহানী পরিবেশে খালেছ তাকওয়া ও ইখলাসের ওপর স্থাপিত হয় মাদরাসার ভিত্তি। ইখলাসের সে ঝলক এখন সবার চোখেই ধরা পড়ছে।
মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে মাদ্রাসাটি দেশের প্রথম সারির দাওরায়ে হাদীস মাদরাসায় উন্নীত হয়েছে। অবকাঠামোগতভাবেও আশাতীত উন্নতি সাধন করেছে। ৩০ শতাংশের জায়গাটি বিস্তৃত হয়ে ৩০০ শতকে পৌঁছেছে। বর্তমানে আরও বিস্তৃত হচ্ছে এবং হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ!
প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণ নাম জামিয়া কুরআনিয়া ইমদাদুল উলূম ফুলছোঁয়া। প্রতি বছর মাদরাসার বিস্তৃত ময়দানে হযরত মুফতী সাহেবের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় দুই দিন ব্যাপী ইসলাহী মাহফিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইশকে ইলাহীর সুরভি মেখে সুরভিত হওয়ার অদম্য বাসনা নিয়ে লোকজন ছুটে চলেছেন ফুলছোঁয়ার সুবাসভরা মাটিতে এবং শরীয়ত ও তরীকতের সমন্বিত চর্চার মাধ্যমে নিজেদের জীবনকে গড়ে তুলছেন ফুলের মত। দেশের অন্যসব মাহফিলের চেয়ে বাস্তবিক অর্থেই ব্যতিক্রম এই মাহফিল। অজস্র অর্থকড়ি ব্যয় করে অনুষ্ঠিত দেশের অসংখ্য ওয়াজ মাহফিলের দশভাগ আয়োজনও যদি ফুলছোঁয়ার আদলে হত তবুও সাধারণ মুসলিম জনতা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের আঁধার পেরিয়ে ইলমের সঠিক আলো গ্রহণ করে প্রকৃত দীনদার হওয়ার সুযোগ পেত। কুরআন হাদীস ও ফিকহের উচ্চতর গবেষণা ও যোগ্য মুফতী তৈরির লক্ষ্যে ফরিদাবাদ মাদরাসার অদূরে আরসিন গেটে তিনি দারুল ফিকরি ওয়াল ইরশাদ নামে নির্ভরযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। এর মাধ্যমে তিনি ইলমে দীনের এক বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির জন্য নিজস্ব জায়গারও এন্তেজাম হয়েছে। অর্থানুকূল্য ও প্রয়োজনীয় সামর্থ্য সাপেক্ষে আরও বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। দরস-তাদরীস ও বয়ান-বক্তৃতার পাশাপাশি দীনি বিষয়ক অনেক লেখালেখির খেদমতও তিনি করেছেন। শিক্ষকতার শুরুর দিকে মাসিক পত্র-পত্রিকা ও সাময়ীকিতে বেশকিছু প্রবন্ধ লিখেন। বেশিরভাগ লেখা মাসিক মদীনায় ছাপা হয়েছে। মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব হযরতকে বিশেষ স্নেহ ও আস্থার নজরে দেখতেন।
ইতিমধ্যে হযরতের লেখা ছোট-বড় কয়েকটি জরুরি বই প্রকাশিত হয়েছে। সমকালীন জরুরি মাসায়েল, আধুনিক সমস্যার ইসলামী সমাধান, চল্লিশ হাদীস, মৌলিক আকীদা, পাঁচ ওয়াক্তের হাদিয়া ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম। আরও কিছু বই বের হয়েছে তাঁর বিশেষ তত্ত্বাবধান ও নিপুণ সম্পাদনায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল ‘মহিলাগণ কোথায় নামায আদায় করবেন’, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে রোগী ডাক্তার ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা’। মানুষের হেদায়াত ও কল্যাণ কামনাই হল তাঁর জীবনের মৌলিক লক্ষ্য। পথহারা মানুষের সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার সাথে কিভাবে গড়ে উঠে, সে সম্পর্ক কিভাবে গভীর থেকে গভীরতর হয়-এই সাধনাতেই তিনি কর্মজীবনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সময় দিয়ে যাচ্ছেন। ফরিদাবাদ মাদরাসা মসজিদ, গেন্ডারিয়া সাধনা মসজিদ ও কুমিল্লা রানির বাজার মসজিদে একেক জুমার খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ ছাড়া সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মসজিদে নিয়মিত ইসলাহী প্রোগ্রাম করেন। সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার সাধনা মসজিদে পবিত্র কুরআনের তাফসীর করেন। একইভাবে মাসিক প্রোগ্রামও রয়েছে প্রচুর। এক কথায় সুবিন্যস্ত রুটিনভিত্তিক নিয়মিত প্রোগ্রামে তাঁর পূর্ণ সময় ব্যয় হয়। দুয়া করি, আল্লাহপাক হযরতকে এ পথে অটল অবিচল রাখুন এবং উম্মতকে বেশি বেশি উপকৃত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন ॥